Home / বাংলা নিউজ / প্রতিমাসে গড়ে তিন নবজাতক মিলে ডাস্টবিন বা সড়কে

প্রতিমাসে গড়ে তিন নবজাতক মিলে ডাস্টবিন বা সড়কে

দেশের সড়ক, ডাস্টবিন, ঝোপে প্রতিমাসে অন্তত গড়ে তিন নবজাতক পরিত্যক্ত অবস্থায় মিলে। কারোরই অভিভাবকের সন্ধান মেলে না কখনও। উদ্ধারের পর এসব নবজাতক সরকারি বা বেসরকারি জিম্মায় থাকলেও অনেকের ভাগ্যে করুণ মৃত্যুও জোটে। এসব ক্ষেত্রে কখনও কখনও হত্যা মামলা হলেও ধরা পড়ে না নবজাতক বা ভ্রূণ হত্যায় জড়িত কেউ।

রবিবার (৩১ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে এক কলারের ফোন কলে ডাস্টবিনের পাশ থেকে এক বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে উদ্ধার করে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার পুলিশ।

চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি থেকে লাবিব নামে একজন পথচারী কলার ফোন করে জানান, সেখানে একটি ডাস্টবিনের পাশে কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় একটি এক বছর বয়সী কন্যাশিশু পাওয়া গেছে। শিশুটিকে প্রায় ২/৩ ঘণ্টা পূর্বে ঘুমন্ত অবস্থায় ডাস্টবিনের পাশে পড়ে থাকতে দেখে আশপাশের লোকজন আর পথচারীরা। তারা আশপাশে খোঁজ নিয়েছেন, কিন্তু বাচ্চার অভিভাবকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এখন বাচ্চাটি ঘুম থেকে জেগে উঠে কান্নাকাটি করছে। সেখানকার লোকরা শিশুটিকে বিস্কুট পানি এসব খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু কান্না থামাতে পারছিল না। একজন তখন সহায়তা চেয়ে ৯৯৯-এ ফোন করেন।

৯৯৯ সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় জানায়। সংবাদ পেয়ে কোতোয়ালী থানার একটি দল দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। পরে কোতোয়ালী থানার এএসআই সাদেক ‘৯৯৯’-কে ফোনে জানান তিনি কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসছেন। পরে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শিশুটিকে ‘উপলব্ধি’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জাতীয় জরুরি সেবার পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুটি বর্তমানে সুস্থ রয়েছে। এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট ২০৫টি মৃত নবজাতক উদ্ধার হয়। যার মধ্যে ২০১৯ সালে ৪২টি, ২০১৮ সালে ৩৯টি, ২০১৭ সালে ২৪টি, ২০১৬ সালে ২৮টি, ২০১৫ সালে ৫২টি মৃত নবজাতক ছিল। এদের কারও বাবা-মায়ের পরিচয় মেলেনি।

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্মমতার শিকার নবজাতকদের আইনি সহায়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। তাদের সঙ্গে যা ঘটে তা সকল নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়। এটা কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গুরুতর অপরাধ।’

কারা ফেলে যায় নবজাতক

নবজাতক ফেলে যাওয়ার এই ঘটনা কোনোভাবেই কমছে না। এসব ঘটনায় সেসব নবজাতকের বাবা-মায়ের পরিচয়ও মেলে না। তারপরও নবজাতকের সঙ্গে এমন পাষণ্ড মা কিংবা বাবার একটা বড় সূত্র কিন্তু থেকেই যায়। তা হলো ডিএনএ। ওটার সূত্র ধরেও এ পর্যন্ত এমন কাউকে ধরা সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা নবজাতকের পরিচয় ও খুনি শনাক্তে তাদের তদন্তের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। কেবল নবজাতকের ডিএনএ রাখলে তো হবে না। সকল নাগরিকের ডিএনএ থাকলে ম্যাচিং করতে পারতো। কিন্তু কেবল নবজাতকের ডিএনএ সংরক্ষণ করে লাভ নেই। আমাদের দেশের পরিচয়হীন বয়স্ক তো দাফন করা হয় অজ্ঞাত হিসেবে। অনেক সময় বছর ধরে ফ্রিজে রাখা হয় পরিচয় না পেয়ে। এমন লাশও আছে ডিএমসিতে। বয়স্কদের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র খোঁজা হয়। কিন্তু নবজাতকদের সেই পদ্ধতিও থাকে না।

তিনি আরও বলেন, নবজাতক ফেলে দেওয়া বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো পরিবারের মাধ্যমেই ঘটে। তাই কখনও কেউ অভিযোগ নিয়েও আসে না। পুরো বিষয়টি থাকে সূত্রহীন। ব্যাগে, বস্তায়, কার্টন, বালতিসহ বিভিন্ন কায়দায় গোপনে এসব কাজ করে। যা তদন্ত খুবই চ্যালেঞ্জিং।

সূত্র না মিললে আগায় না তদন্ত। নিহত নবজাতকদের ক্ষেত্রে হত্যা মামলা হলেও বছরের পর বছর সেই মামলার কোনও অগ্রগতি হয় না। তবে পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হয়।

গত ১৪ অক্টোবর বিকালে খিলক্ষেতের একটি সড়কের ফুটপাতে পড়ে থাকা কাপড়ের শপিং ব্যাগ থেকে এক নবজাতক দেখতে পান সমরেশ মণ্ডল নামে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। খিলক্ষেত থানায় জানালে, নবজাতককে উদ্ধার করে খিলক্ষেত থানা পুলিশ।

উদ্ধারের পর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে সমাজ সেবা অধিদফতরের পরিচালিত আজিমপুরের ছোটনিবাসে পাঠানো হয় শিশুটিকে। শিশুটি এখন সেখানেই আছে। নবজাতক পুলিশের সহায়তায় জীবন পেলেও পুলিশ তার এই পরিণতির জন্য দায়ীদের আটক করতে পারেনি।

খিলক্ষেত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বোরহান উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নবজাতককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। এরপর কী হয়েছে আর জানি না। তবে জানতে পেরেছি শিশুটি সুস্থ আছে।’

নবজাতককে কারা কীভাবে এখানে রেখে গেলো, কোনও ক্লু আছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘কাউকে আটক করা হয়নি। জানা যায়নি নবজাতকটি কীভাবে ওখানে এলো।’

খিলক্ষেতের এই ঘটনার ছয়দিন পর গত ২০ অক্টোবর সকালে রাজধানীর হাজারীবাগ থানার ৫৩ এনায়েতগঞ্জ লেনের একটি ময়লার বালতি থেকে একটি কন্যাশিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজিদুর রহমান সাজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুটিকে এলাকার কেউ চিনতে পারছে না। একটি ডাস্টবিনের কাছে ময়লার বালতিতে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। আমরা ধারণা করছি, শিশুটিকে অন্য কোথাও মেরে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে। শিশুটির বয়স এক থেকে দেড় বছর হবে।’

ঘটনার পর হাজারীবাগ থানা পুলিশ অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছে। তবে এই মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। ওসি জানান, ‘আমরা লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করিয়েছি। নবজাতককে এলাকার কেউ চেনে না। ঘটনার পর ওই সড়কের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করেছি, কিন্তু নবজাতককে রাতে রেখে যাওয়ায় ফুটেজও অন্ধকার। কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি। তদন্ত চলছে।’

পরিত্যক্ত অবস্থায় নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ প্রতিটি ঘটনাতেই হত্যা মামলা করে। এসব মামলা তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগে। অভিযোগপত্রও হয় নগণ্য।

খিলক্ষেত্র ও হাজারীবাগের এই ঘটনার পর গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাস থেকে নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়নি, কীভাবে নবজাতকের লাশ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে এলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খুবই অমানবিক একটি কাজ হয়েছে। কে বা কারা শিশুটিকে ফেলে গেছে জানা যায়নি।’

আইনজীবী ইশরাত হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জন্মের পর একটি নবজাতকের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে, যা সকল নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়। জন্মের পরই সে নির্মমতার শিকার হয়। এটা কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গুরুতর অপরাধ।’

Check Also

অসুস্থ হয়েও অন্য মানুষের সহায়তায় এগিয়ে গেলেন তাসরিফ

তাসরিফ খান নাম টা সামনে এলেই ২০২২ সালে সিলেটের বন্যার কথা মনে পড়ে যায়। সেসময় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *