Home / মিডিয়া নিউজ / জাফর ইকবাল: গাইতে গিয়ে নায়ক

জাফর ইকবাল: গাইতে গিয়ে নায়ক

গিটার বাজাতেন ভালো। চলনে-বলনে অনুসরণ করতেন রক এন রোলের রাজা এলভিস প্রিসলিকে। আশির দশকে ছিলেন দাপুটে নায়ক। তার সময়ের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন ও স্টাইলিস্ট অভিনেতা। অথচ চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবালের জন্ম সুরের ভুবনে। গায়কই হওয়ার কথা ছিল তার। তিনি তো গায়কই। ব্যান্ড ছিল তার। অ্যালবামও অাছে।

জাফর ইকবাল মানে কালজয়ী অনেক গানে অভিনয় করা প্রিয়মুখ। দারুণ সব গানের প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যায় তার কথা। এসব গান পুরনো হওয়ার নয়। পুরনো হবে না তার অভিনয়। নিজের গাওয়া গান ও চলচ্চিত্রের সুবাদে ভক্তদের ভালোবাসায় ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি। চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন ক্ষণজন্মা এই তারকা।

ফ্যাশন আইকন

কণ্ঠ, অভিনয়, ফ্যাশন ও স্টাইল মিলিয়ে জাফর ইকবাল ছিলেন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী। আশির দশকে তরুণদের ফ্যাশন আইকন ভাবা হতো তাকে। একজন অনবদ্য অভিনেতার পাশাপাশি গায়ক ও স্টাইলিশ মানুষ হিসেবে বিস্তৃত তার শিল্পীসত্তার পরিধি। নায়ক-গায়ক জাফর ইকবাল যেন চিরসবুজের প্রতিভু। ওই সময়ের নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ ছিলেন এই হার্টথ্রুব। তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তার জনপ্রিয়তার পাল্লা ছিল ভারি। তার কথা বলা, হাঁটা, গিটার বাজানো—সবই দারুণ লাগতো!

গান না শিখেই গায়ক

১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন জাফর ইকবাল। তার সাংস্কৃতিক যাত্রা শুরু গান দিয়ে। তবে তিনি কারও কাছে গান শেখেননি। সুরের ভুবনে বেড়ে ওঠায় গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। বড় ভাই অমর সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ ও ছোট বোন কিংবদন্তি গায়িকা শাহনাজ রহমতউল্লাহর দেখাদেখি নিজেও গাওয়ার চেষ্টা করতেন। ভাইবোনের মতো গানটাকে ভালোবাসতে শেখেন, গাইতে শুরু করেন। গিটার বাজানোতে আলাদা দক্ষতা ছিল জাফর ইকবালের। এসএসসি পাস করার আগেই গিটার বাজানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন। এলভিস প্রিসলি ছিল তার প্রিয় শিল্পী। স্কুলে কোনও অনুষ্ঠান থাকলেই গিটার বাজিয়ে এলভিস প্রিসলির গান গাইতেন তিনি। সাংগীতিক আবহে বেড়ে ওঠা জাফর ইকবালের আবির্ভাব সংগীতশিল্পী হিসেবে।

ব্যান্ড গড়া

গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে জাফর ইকবাল গঠন করেছিলেন র‌্যাম্বলিং স্টোনস নামের একটি ব্যান্ড। সেই সময়ে ব্যান্ড নিয়ে দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তারা। প্রতি শনি ও রবিবার ওই হোটেলে সংগীত পরিবেশন করতো ব্যান্ডটি।

গিটারবাদক

রুপালি পর্দায় বিচরণের আগে গিটারবাদক ছিলেন জাফর ইকবাল। সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে গিটার বাজাতেন। ইন্দিরা রোডের স্টুডিওতে রবিন ঘোষের সুরে ‘পিচঢালা এই পথটাকে ভালোবেসেছি’ গানে গিটার বাজান তিনি। কালজয়ী এই গানের গিটারের পিস তারই বাজানো। এছাড়া অনেক ছবির আবহসংগীত করেছেন তিনি।

গাইতে গিয়ে নায়ক

নিজের ব্যান্ড নিয়ে কনসার্টে গাইতে গিয়ে নজরে পড়েন জাফর ইকবাল। ১৯৬৯ সালের কথা। একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে তাকে দেখে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ খান আতাউর রহমান মুগ্ধ হন। তার পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে ওই বছরই নায়ক হিসেবে পর্দায় আগমন ঘটে জাফর ইকবালের। বিপরীতে ছিলেন কবরী।

অভিষেক চলচ্চিত্রেই একটি সুপার-ডুপার হিট গান চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জাফর ইকবালকে নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়। ‘আপন পর’-এ প্রয়াত সংগীতশিল্পী বশির আহমেদের কণ্ঠে ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি/যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি’ গানটি এখনও শ্রোতাপ্রিয়। এর কথা ও সুর খান আতার। পরবর্তী সময়ে জাফর ইকবালের ঠোঁট মেলানো অনেক গান জনপ্রিয় হয়েছে।

জাফর ইকবাল একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জাফর ইকবাল। তাই শুধু অভিনেতা বা গায়ক নন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবেও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি চিরস্মরণীয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর অভিনয়ে পুরো মনোনিবেশ করেন এই তারকা।

বলিউডের রিমেক

স্বাধীন দেশে রাজেশ খান্না অভিনীত ‘রোটি’র রিমেক ছবিতে অভিনয় করে নজর কাড়েন জাফর ইকবাল। ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত’ নামের এই ছবিতে ‘শোনো ভাইয়েরা কথা শোনো এমন একজন মানুষ আনো যে জন পাপ না করেছে, যে পাপী নহে’ গানে অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি।

জাফর ইকবাল বেশ কিছু ছবিতে গায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেগুলো বেশ জনপ্রিয়তাও পায়। এরমধ্যে অন্যতম ‘নয়নের আলো’। এই ছবির সব গান যুগ যুগ ধরে শ্রোতার মুখে মুখে ফিরছে। এগুলো হলো, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে/মন যেখানে হৃদয় সেখানে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়োগো মাটি/এই চোখ দুটো তুমি খেয়ো না’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান/সেদিন থেকে গানই জীবন, গানই আমার প্রাণ’, ‘এই আছি এই নাই/বলো এই আছি এই নাই/দুদিন পরে কেউবা ধুলো/কেউবা হবো ছাই’। বেলাল আহমেদ পরিচালিত এ ছবিতে জাফর ইকবালের চরিত্রটি গ্রামের একজন বাউলের ছেলে বাউল শিল্পীর। অতি সাধারণ ছেলেটি মাঠেঘাটে গান করে বেড়ায়। এর আগে মূলত ফ্যাশনেবল শহুরে ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। দর্শকরা তাকে গ্রামীণ চরিত্রেও গ্রহণ করেন।

অন্য নায়কদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করার চমৎকার দক্ষতা ছিল জাফর ইকবালের। যেকোনও চরিত্রের দৃঢ়তা দারুণভাবে ধরতে পারতেন তিনি। যেমন বন্ধুত্ব নিয়ে নির্মিত দুই ছবি ‘বন্ধু আমার’ ও ‘ভাই বন্ধু’। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দুটি ছবিরই প্রধান দু্ই অভিনেতার একজন অন্ধ। ‘ভাই বন্ধু’তে পর্দার আড়ালে থাকা অন্ধ গায়কের চরিত্রে জাফর ইকবাল। আর ‘বন্ধু আমার’-এ অন্ধ থাকেন ফারুক। দুটি ছবিতেই তারা দৃষ্টি ফিরে পান। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দুটি ছবিতেই অন্ধ চরিত্র দুটি গায়ক!

শুধু জনপ্রিয় চিত্রনায়কই নন, জাফর ইকবাল ছিলেন গায়কও। তার গাওয়া গানগুলো সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়। সে সময় তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফিরত এগুলো। বাস্তবে চমৎকার গাইতে পারা জাফর ইকবাল প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘পিচঢালা পথ’ ছবিতে। রুনা লায়লার সঙ্গে এতে দ্বৈত কণ্ঠ দেন তিনি।

‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও, আমি তো এখন আর নই কারও/ অন্ধগলির এই যে আঁধার, বন্ধু হলো আজ আমার’ গানটিও তার গাওয়া। নিজের পরিচালনায় এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক।

দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি আলাউদ্দিন আলির সুর ও সংগীত পরিচালনায় রুনা লায়লার সঙ্গে ‘প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে’ গানে কণ্ঠ দেন জাফর ইকবাল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’ গানে কণ্ঠ দিয়ে মোহামেডানের পক্ষ নেন তিনি।

একক অ্যালবাম

চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় গানে বেশি সময় দিতে পারেননি জাফর ইকবাল। তবু গানে তার জনপ্রিয়তা ছিল। বিটিভির ‘আনন্দমেলা’য় বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি নিজের গাওয়া গানগুলো নিয়ে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ নামে একটি একক অ্যালবাম বের করেন তিনি।

সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী

সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা ও সাদা টি-শার্ট—এমন সাদামাটাভাবেই বিটিভিতে জাফর ইকবাল পরিবেশন করেন ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারও ঘরনী/জেনে রাখো প্রাসাদেরও বন্দিনী, প্রেম কভু মরেনি’। ব্যর্থ প্রেমিকের অার্তনাদ প্রকাশে এটি এককথায় ধ্রুপদী।

বিটিভির রজতজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’।

জাফর ইকবালের অনবদ্য গানের তালিকায় আরও আছে ‘যেভাবেই বাঁচি, বেঁচে তো আছি, জীবন আর মরণের কাছাকাছি’, ‘শেষ করো না, শুরুতেই খেলা, না ভেঙো না’, ‘বিদেশ থেকে দেশে অাইলে’। তিনি প্রায় ২০০টি গান গেয়েছেন।

অভিমানী, খামখেয়ালি

জাফর ইকবাল ছিলেন প্রচণ্ড অভিমানী ও খামখেয়ালি একজন মানুষ। বেঁচে থাকলে আজ ২৫ সেপ্টেম্বর জাফর ইকবালের বয়স হতো ৬৮ বছর। ১৯৯১ সালের ২৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দুই যুগেরও বেশি সময় পরেও তাকে মিস করেন সবাই। চিরকালই হয়তো এই শূন্যতা থেকে যাবে। বাংলা সংস্কৃতি তার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।

ববিতা ও জাফর ইকবাল

ববিতা ও জাফর ইকবাল

জাফর ইকবালের ঠোঁট মেলানো জনপ্রিয় ২০ গান

* আমার বাবার মুখে (নয়নের আলো)

* আমার সারাদেহ খেওগো মাটি (নয়নের আলো)

* ‘আমার বুকের মধ্যিখানে (নয়নের আলো)

* ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা (ভাই বন্ধু)

* তুমি এলে সমুখে

* তুমি অামার জীবন (অবুঝ হৃদয়)

* কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে (উসিলা)

* যারে যাবি যদি যা (অাপন পর)

* ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও (ওগো বিদেশিনী)

* চাঁদের সাথে অামি দেবো না (অাশীর্বাদ)

* একটাই কথা অাছে বাংলাতে (বন্ধু আমার)

* সকালটা যে অামার (যোগাযোগ)

* অামি তোমার মনের মতো কিনা (গর্জন)

* শোনো সোমা একটু দাঁড়াও, কথা শুনে যাও (প্রতিরোধ)

* এই যে দুনিয়া কীসেরও লাগিয়া (দোষী)

* সত্য কি মিথ্যে কি (ভাই বন্ধু)

* ফুল ফোটা ফাগুনে, মন পোড়া আগুনে (প্রেমিক)

* অন্ধ হয়ে থেকো না কেউ (ভাইবন্ধু)

* শোনো ভাইয়েরা কথা শোনো এমন একজন মানুষ আনো (এক মুঠো ভাত)

* এই আছি এই নাই (নয়নের আলো)

Check Also

আমি নায়িকা ছিলাম, নায়িকা হয়েই মরবো: নূতন

ঢাকাই সিনেমার সোনালি যুগের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নূতন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মূল থেকে পার্শ্ব চরিত্র; তিন শতাধিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *