





ফরিদা আক্তার পপি যাকে আমরা ববিতা পরিচয়ে চিনি। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবং প্রযোজক।






তিনি ৭০-৮০র দশকের অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।






এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা তিনি প্রথম উড়িয়েছিলেন। ববিতা ৩০০টির ও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।






তিনি ১৯৭৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন। এছাড়া ১৯৮৬ সালে আরেকবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক এবং ২০০৩ ও ২০১৩ সালে দুইবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০১৮ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়।
ববিতা ১৯৫৩ সালে ৩০ জুলাই বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায় জন্ম নেন। তাঁর বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং মাতা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। বাবার চাকরি সূত্রে তারা তখন বাগেরহাটে থাকতেন। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলায়। শৈশব এবং কৈশোরের প্রথমার্ধ কেটেছে যশোর শহরের সার্কিট হাউজের সামনে রাবেয়া মঞ্জিলে। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়বোন সুচান্দা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, বড়ভাই শহীদুল ইসলাম ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মেজভাই ইকবাল ইসলাম বৈমানিক, ছোটবোন গুলশান আখতার চম্পা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং ছোটভাই ফেরদৌস ইসলাম বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। এছাড়াও অভিনেতা ওমর সানী তাঁর ভাগ্নে এবং অভিনেত্রী মৌসুমী তাঁর ভাগ্নে বউ (ওমর সানীর স্ত্রী) এবং অভিনেতা রিয়াজ তাঁর চাচাত ভাই। চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান তার ভগ্নিপতি। ববিতার পরিবার একসময় বাগেরহাট থেকে ঢাকার গেন্ডারিয়াতে চলে আসে। তাঁর মা ডাক্তার থাকায়, ববিতা চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে।
ববিতার প্রথম স্কুল ছিলো যশোর দাউদ পাবলিক বিদ্যালয়। সেখানে অধ্যয়নকালে বড়বোন সুচান্দা চলচ্চিত্রে প্রবেশের সূত্রে পরিবার সহ চলে আসেন ঢাকার গেন্ডারিয়াতে। গেন্ডারিয়ার বাড়ীতে শুরু হয় কৈশরের অবশিষ্টাংশ। এখানে তিনি গ্লোরিয়া স্কুলে পড়াশুনা করেন। চলচ্চিত্রে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট অর্জন না করলেও ববিতা ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। দক্ষতা অর্জন করেন ইংরেজিসহ কয়েকটি বিদেশী ভাষায়। নিজেকে পরিমার্জিত করে তোলেন একজন আদর্শ শিল্পীর মাত্রায়।
আশির দশকের শুরুতে ববিতা চট্টগ্রামের সন্তান চলচ্চিত্র পরিচালক ইফতেখারুল আলমকে বিয়ে করেন। তবে তাদের এ সংসার বেশিদিন টিকে নি। স্বামীর মৃৃত্যুর পর ববিতা একাই সংগ্রাম করে ছেলেকে মানুষ করেছেন। তাই অভিনয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের জন্য ঠিকই সময় বের করে নিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে তিনি অনিককে পড়াশোনার জন্য কানাডায় পাঠান। ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রায় ছয় মাস কানাডায় অবস্থা মন করেন।
বড়বোন সুচন্দা অভিনীত জহির রায়হানের সংসার চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে ববিতার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রাথমিক নাম ছিলো “সুবর্ণা“। তিনি কলম নামের একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলেন। জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই তাঁর নাম “ববিতা” হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে “শেষ পর্যন্ত” চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রথম নায়িকা হিসেবে। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে ভগ্নিপতি জহির রায়হানের পথ প্রদর্শনে চললেও পরে তিনি একাই পথ চলেছেন। জহির রায়হানের পরিচালিত ‘টাকা আনা পাই’ সিনেমাটা ছিল তাঁর জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এরপর তিনি নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’ সিনেমাতে অভিনয় করেন যা ছিল সেই সময়ের সুপারহিট সিনেমার মধ্যে একটি।
১৯৭৩ সালে বিভূতিভুষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিত রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘অশনি সংকেত’ এ অভিনয় করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হন ববিতা এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করেন। এই ছবিতে ববিতার অভিনয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশে ভারতীয় চিত্রগ্রাহক বাংলাদেশে এসে ববিতার প্রায় দুইশ ছবি তুলেন। এর কিছুদিন পরে ভারতীয় হাই কমিশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক মনোনয়ের কথা জানিয়ে চিঠি আসে। পরবর্তীতে ববিতা বোন সুচন্দাসহ ভারতে সত্যজিৎ রায়ের সাথে দেখা করেন এবং সেখানে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা আলোচনার পর সত্যজিৎ রায় তাকে অনঙ্গ বউ চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেন। এই ছবিতে অভিনয় করে ববিতা একাধিক পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন।
শুরুর দিকে বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও পরবর্তীতে ববিতা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পুরোপুরি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন। আশির দশকের শেষের দিকে তিনি মুটিয়ে যান এবং কেন্দ্রিয় চরিত্রের অভিনয় থেকে দূরে সরতে থাকেন। বর্তমানে তিনি মা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ববিতা মুলত প্রকৃতি প্রেমি। তিনি বাগান করতে খুব পছন্দ করেন। তিনি তার বিশালবহুল বাড়িতে ও ছাদে নানা রঙের দেশী বিদেশী ফুলের ও ফলের গাছ ও বিভিন্ন রকমের বনসাই গাছ লাগিয়েছেন। শুধু তাই নয় তিনি তার বাড়ির ভেতর ,বারান্দা ও ছাদকে এক গ্রামের প্রকৃতির এক টুকরো রূপ তুলে ধরেছেন।