Home / মিডিয়া নিউজ / যে ঘটনা মোশাররফ করিম কোনো দিনই বলেননি তার মাকে

যে ঘটনা মোশাররফ করিম কোনো দিনই বলেননি তার মাকে

ছোটবেলায় আমি প্রচণ্ড ডানপিটে ও দুষ্টু ছিলাম। সেই দুষ্টুমির জন্য শাসন করার

একমাত্র মানুষ ছিলেন আমার মা। বাবা আমাকে খুব বেশি শাসন করতেন না।

ফলে, আমার বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও মায়ের সঙ্গে তা হয়নি।

বলা যায়, ওই সময়ে আমার মায়ের প্রতি একটু রাগ হতো। এমনও হয়েছে, মায়ের জ্বর হলে আমি খুশি হতাম। এটার কারণ হলো, মা শুয়ে থাকলে আমি অনায়াসে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারতাম।

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমার মা প্রচণ্ড চাপা স্বভাবের। অনেক সময় মনে হয়, তিনি তাঁর আবেগ প্রকাশ করতে লজ্জা পান কিংবা প্রকাশ করতে ভালোবাসেন না। মা বরাবরের মতো রাশভারী মানুষ। তাঁর দুঃখ বা কষ্টের কথা কখনো কাউকে বলেন না।

এমনকি আমার কোনো বিষয়ে তিনি আনন্দিত হয়েছেন কি হননি, সেটাও প্রকাশ করেন না। সেই জায়গা থেকে মাকে বোঝা আমার জন্য সত্যি কঠিন। মাঝেমধ্যেই মনে হতো, আমার মা কি অন্য সব মায়ের মতো? ওই রকম স্নেহশীল? ভালোবাসাপরায়ণ?

এই রকম একটা অনুভূতির মধ্য দিয়ে আমি দিন পার করেছি। কিন্তু আমার সব ধারণা ভেঙেচুরে গিয়েছে তাঁর মুখে একটা ঘটনা শুনে।

সে ঘটনা বলছি। তবে এটুকু বলে নেওয়া উচিত—সে গল্প আমার উদ্দেশে তিনি বলেননি। একদিন খাওয়ার ঘরে বসে কারও সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমি আমার শোবার ঘর থেকে সেটা শুনছিলাম।

সময়টা ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি হবে। আমার বয়স তখন দু-তিন মাস। তখন মাসহ পরিবারের কয়েকজন লঞ্চে ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছিলেন। ভোর কিংবা সন্ধ্যাবেলার ঘটনা। হঠাৎ লঞ্চ লক্ষ্য করে দুই পাড় থেকে তীব্র গুলি শুরু হলো। লঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশে গুলি বের হয়ে যাচ্ছে। লঞ্চের ডেকের সব যাত্রী শুয়ে পড়েছে।

আমার ওইটুকুন শরীরের ওপরও কয়েকজন শুয়ে পড়েছে। আসলে ওই সময় কারও হুঁশ নেই। নিজের জীবন বাঁচানোই বড় ব্যাপার। মা আমার ওপর কয়েকজনকে শুয়ে পড়তে দেখে যাকে যেভাবে পারছেন সরিয়ে দিচ্ছেন। সরানোর পর নাকি দেখেন, আমি অচেতন। গোলাগুলি তখনো চলছে। একটু পানি হলে হয়তো আমি বেঁচে যাব।

ওই সময় পানি আনতে হলেও লঞ্চের আরেক প্রান্ত দিয়ে নিচতলায় যেতে হবে। ওই প্রান্তে যেতে হলে উঠে দাঁড়াতে হবে এবং হেঁটে যেতে হবে। হেঁটে যাওয়ার সময় গুলি লাগার আশঙ্কা শতভাগ। মা ওই সময় ঝুঁকি নিলেন। পানি এনে আমার মুখে দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন।

এ ঘটনা আমার মা কোনো দিনই বলেননি। সেদিন শুনে ফেলেছি। পরে অনেক ভেবে আমার মনে হয়েছে, উনি কখনোই বোঝাতে চাননি বা বলতে চাননি, ’আমি তোর জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিলাম!’

এসব কারণেই আমার মনে হয়, মা সবার কাছে একটা ব্যাখ্যাতীত মানুষ। আমার মনে হয় পৃথিবীতে বহু মানুষের সঙ্গে বহুজনের সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্কের কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটার কোনো সংজ্ঞা নেই।

এই সম্পর্কটার একটা অদ্ভুত অসহায়তা আছে। এটা হলো আবেগের অসহায়তা। যেমন আমি যদি চাই, আমার মাকে আমি অনুভব করব না বা মা আমাকে করবেন না। এটা কিন্তু সম্ভব না। আমি যত অপরাধই করি না কেন, আমার মা কিন্তু ঠিকই আমাকে অনুভব করবেন।

এটাই আবেগের অসহায়তা। এই সম্পর্কের ব্যাপারটাই এ রকম। কিন্তু ওই গল্পটা শোনার পর আমি মাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। আমার প্রতি তাঁর যে আবেগ,

সেটা কখনোই তিনি দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। এটাই সম্ভবত মায়ের ব্যক্তিত্ব। তাই আমার কাছে মায়ের ভালোবাসা ব্যাখ্যাতীত একটা বিষয় বলে মনে হয়; যা আমার মতো সাধারণের পক্ষে প্রকাশ করা কঠিন।

Check Also

আমি নায়িকা ছিলাম, নায়িকা হয়েই মরবো: নূতন

ঢাকাই সিনেমার সোনালি যুগের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নূতন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে মূল থেকে পার্শ্ব চরিত্র; তিন শতাধিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *